মেয়ের হাড্ডিগুলা দেন, ওর মায়ের কাছে নিয়ে যাই
‘আগুনে পুইড়া তো কয়লা হয়ে গেছে। মেয়ের হাড়-হাড্ডি যা আছে দেন, ওর মায়ের কাছে নিয়া দেই। হাড়-হাড্ডি পাইলেও তো ওর মা একটু সান্ত্বনা পাবো। যা ব্যবস্থা করার দ্রুত করেন’— কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমন আকুতি জানাচ্ছিলেন এক বাবা। তার তিন সন্তানের একজন নুসরাত জাহান টুকি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড লিমিটেডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন। ২৪ বছরের নুসরাত ওই প্রতিষ্ঠানে সহকারী সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
নুসরাতের বাবা হাসানুজ্জামান জানান, তার মেয়ে রাজশাহী মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ফুড অ্যান্ড বেভারেজে পড়াশোনা করেছে। এরপর বিএসসি করতে চেয়েছিল সে। এরমধ্যে হাসেম ফুড থেকে চাকরির অফার পেয়ে গত ৭ মার্চ এখানে যোগদান করে। বৃহস্পতিবার নুসরাতের এক সহকর্মীর কাছে আগুনের খবর পান তিনি। এরপর মেয়ের মোবাইলে অসংখ্যবার কল করেছেন কিন্তু কেউ ধরেনি। এক পর্যায়ে মোবাইল ফোনটিও বন্ধ হয়ে যায়। লকডাউনের কারণে শুক্রবার পুলিশের অনুমতি নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। শনিবার (১০ জুলাই) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডির কাছে মেয়ের মৃতদেহ শনাক্তের জন্য ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন।
শনিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে আসছেন স্বজনরা। স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এদিন বিকাল পর্যন্ত সিআইডির ডিএনএ ফরেনসিক ল্যাব ১৮টি মৃতদেহের বিপরীতে ২৫ জন স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করেছে। সব মিলিয়ে ৩৭টি মৃতদেহের বিপরীতে ৫১ জন স্বজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
ডিএনএ নমুনা দেওয়া শেষে নুসরাতের বাবা হাসানুজ্জামান বলেন, ‘কথা বলে কী হবে? কিছুই তো হবে না। আপনারা শুধু আমার মেয়েটাকে দ্রুত শনাক্ত করে দেন। আমার মেয়েটার হাড়-হাড্ডি দেন। আমি যেন তার মায়ের কাছে নিয়া দিতে পারি। তার মারে যেন সান্ত্বনা দিতে পারি। যেন বলতে পারি মেয়েকে জীবিত আনতে পারি নাই, কিন্তু হাড়-হাড্ডি আনছি। এগুলো যেন যত্ন করে দাফন করতে পারি।’
শনিবার বিকালে মা নাজমা বেগমের খোঁজে স্বজনদের সঙ্গে মর্গে এসেছিলেন ১৩ বছরের নাজমুল হক। বছরখানেক আগে মা-ছেলে একসঙ্গে হাসেম ফুড লিমিটেডে কাজে ঢোকেন। মা নাজমা বেগম কাজ করতেন চতুর্থ তলায়, আর ছেলে নাজমুল দ্বিতীয় তলায়। বাবা অন্যত্র থাকেন, তাই মা-ছেলের রোজগারেই চলতো তাদের সংসার। ছোট্ট একটা বোন আছে তার।
সিআইডির কাছে ডিএনএ নমুনা দেওয়ার পর নাজমুল জানান, ঘটনার দিন বিকেল ৪টায় তার ডিউটি শেষ হয়। তিনি কারখানা থেকে বেরিয়ে যান। মায়ের ওভারটাইম চলছিল। তার বের হওয়ার কথা ছিল আটটায়। আটটার সময় কারখানার সামনে এসে মাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু তার আগেই ভয়াবহ আগুন। মায়ের ফোনে একাধিকবার কল দিয়েছেন কিন্তু ধরেনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাজমুল বলেন, ‘আগুনের ঘটনা শুনে দৌড়ে কারখানার সামনে গিয়ে দেখি দাউদাউ কইরা জ্বলতাছে। কি করুম কিচ্ছু করার ছিল না। চোখের সামনেই হয়তো ভিতরে মায়ে আমার পুইড়া মরছে। এখন আমগো কী হইবো? কে দেখবো আমার ছোট বোনরে?’ বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। নাজমুলের সঙ্গে ছিলেন মামা ফারুক। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই তার মুখেও।