জাতীয়

পোড়া গন্ধ: ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে বঙ্গবাজার

দেশের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাকের পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র বঙ্গবাজার। যেখানে সবসময়ই একপ্রকারের হাঁকডাক লেগে থাকে। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে রমরমা অবস্থায় থাকে বঙ্গবাজার। একদিন আগেও ঠিক তেমনটাই ব্যবসা মুখর ও ক্রেতা বিক্রেতায় সরব ছিল। কিন্তু একদিন বাদে শুধুই হাহাকার। ধ্বংসস্তুপ, পোড়া গন্ধ, ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখন বঙ্গবাজার।

 

বুধবার ৫ এপ্রিল সরেজমিনে দেখা যায়, নতুন কাপড়ের গন্ধের বদলে সেখানে শুধুই পোড়া গন্ধ। বঙ্গবাজারের পাশপাশি ভয়াবহ এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের সাততলা এনেক্সকো টাওয়ারেও। অগ্নিকাণ্ডের পর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এনেক্সকো টাওয়ারের পঞ্চম ও ওপরের তলাগুলোতে পানি ছেটানো অব্যাহত রেখেছে ফায়ার সার্ভিস। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলা থেকে একের পর এক বস্তা ফেলা হচ্ছে নিচে। অগ্নিকাণ্ডের পর অবশিষ্ট কাপড়সহ যেসব মালামাল রয়েছে মূলত সেগুলোই বস্তায় করে নিচে ফেলা হচ্ছে। চারদিকে অসংখ্য উৎসুক মানুষের উপস্থিতি। সব মিলিয়ে মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচির চেনা আবহেও অপরিচিত এক বঙ্গবাজার। জীবনের শেষ সম্বল হারানো হাজারও ব্যবসায়ীরা ঘুরে ঘুরে তা দেখছেন আর স্মৃতিচারণ করছেন।

এনেক্সকো টাওয়ারের ইমরান গার্মেন্টসের কর্মী হাবিবুর রহমান বলেন, ওপরে শুধু কাপড়ের দোকান। সেখানে কাপড়ের গোডাউন থাকায় অনবরত ধোঁয়া বের হচ্ছিল। এ ছাড়া অবশিষ্ট মালামালের যেন ক্ষতি কম হয়, তাই পানি ছেটাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। আর এর মধ্যেই আমাদের মতো দোকানগুলোর লোকজন মালামাল বের করার চেষ্টা করছে।

 

আগুনের উৎস নিয়ে ধোঁয়াশা

মার্কেটে আগুনের উৎস নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টিতে একপক্ষ বলছে, বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। আরেক পক্ষ বলছে, আগুন লাগানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে আগুন নেভানোর গাফিলতি ছিল বলে অভিযোগ করেছেন দোকানের মালিক ও কর্মচারীরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পাশাপাশি অবস্থান করায় আদর্শ, মহানগর, বঙ্গ ও গুলিস্তান মার্কেটগুলো সাধারণত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স নামে পরিচিত। ফজরের নামাজের পর আগুনের সূত্রপাত। আগুন লাগার পরপরই মার্কেটে থাকা সিকিউরিটি গার্ড ও ইলেকট্রিশিয়ানরা ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। পরে তারা ব্যর্থ হয়ে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেন। দীর্ঘ সাড়ে ৬ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার তথ্য জানায় ফায়ার সার্ভিস।

 

আগুন লাগার বিষয়ে ভিন্নকথা জানিয়ে মহানগর মার্কেটের ইলেকট্রিশিয়ান মো. সুমন মিয়া বলেন: মার্কেট বন্ধ হওয়ার পরও মার্কেটের ভেতরে বিদ্যুৎ থাকে। কিন্তু এটা শর্ট সার্কিট থেকে লেগেছে বলে মনে হয় না। যদি শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগে, তাহলে এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত না। আমার মনে হয় কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

 

সেহরির সময়ও কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস

বুধবার ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার এরশাদ হোসাইন বলেন, বঙ্গবাজার মার্কেটের মূল আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে মঙ্গলবার দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে। এর পর আগুন নির্বাপণ ও ডাম্পিংয়ের কাজের জন্য ফায়ার সার্ভিসের ৪০টি ইউনিট ভোর রাতেও কাজ চালিয়েছে।

 

বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ড নতুন নয়

১৯৯৫ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয় এই মার্কেটের সিংহভাগ দোকান।সেই সময়ে প্রায় ২,২০০ দোকান আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সর্বস্বান্ত হন হাজারো দোকানমালিক। সবমিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটিতে দাঁড়ায়। তাছাড়া পাঁচ বছর আগেও, ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই, আরেকটি অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয় পুড়ে যায় বঙ্গবাজারের গুলিস্তান ইউনিটের বেশকিছু দোকান।

 

মঙ্গলবার ৪ এপ্রিল রাজধানীর বঙ্গবাজারের আগুন দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। তাদের ৪৮টি ইউনিটের প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

 

সকাল ৬টা ১০ মিনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় কয়েকটি ইউনিট। পরে ক্রমান্বয়ে ইউনিট বাড়ানো হয়। শেষ পর্যন্ত ৪৮টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে যুক্ত হয়। এতে সম্মিলিতভাবে যুক্ত হয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী বিজিবি র‌্যাব ও ওয়াসা সদস্যরা।

 

বঙ্গবাজার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় পাঁচ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার। এমন দাবি করে প্রাথমিকভাবে ৭০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ চেয়েছন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন।

 

বঙ্গবাজারে মঙ্গলবার সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে ৫ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। একইসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দিয়েছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker