মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা
যুদ্ধের সময় যেকোনো প্রচার মাধ্যমই প্রধানত দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে । একটি হলো যুদ্ধ সংক্রান্ত খবর জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেয়া, দ্বিতীয়টি হলো মোটিভেশনাল, বা উদ্বুদ্ধকরণ। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমত বেতার-ই প্রাধান্য পায়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই স্থানান্তরযোগ্য সরঞ্জাম নিয়ে বেতার পরিচালনা করা হয়। একে সাহায্য করেন সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক , আইন ব্যবসায়ী ও শিক্ষাবিদ সকলেই। রণক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাজ করেন সাংবাদিকরাও । এই সাংবাদিকগণ রণাঙ্গন থেকে সংবাদ পাঠিয়ে বেতার পক্ষকে সমৃদ্ধ করেন।
বেতারে যুদ্ধ সংবাদের নিউজ বুলেটিন তৈরি ও প্রচার করা হয় বিভিন্ন সময়ে। বেতার কেন্দ্রে জনগণ ও মুক্তিফৌজ কে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়োজনে নানা ধরনের প্রোগ্রাম প্রস্তুত করা হয় – যার ভেতরে কথিকা,আবৃত্তি, গান, সাক্ষাৎকার, জীবন্তিকা, নাটক, রসাত্মক পরিবেশনা, কথকতা ইত্যাকার নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। বক্তৃতার অংশবিশেষ উল্লেখ করেও উদ্ধৃতি অনুষ্ঠান ও শ্লোগান প্রচার করা হয়।তাই বেতারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কোনো একটি বেতার তরঙ্গ নির্ধারিত করে তার মাধ্যমে তথ্য প্রচারের ব্যবস্থা করা সম্ভব।যেকোনো লোক এই বেতার তরঙ্গ বা ফ্রিকুয়েন্সি অনুসন্ধান করলেই পরিকল্পিত বেতারের অনুষ্ঠানসূচী শুনতে পারবেন। কোরিয়া,ভিয়েতনাম,কম্পুচিয়া,অ্যাঙ্গোলা,মোজাম্বিক,শ্বেতাঙ্গ শাসিত দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিলিপাইনে মরো কিংবা বার্মার বিদ্রোহীদের মত অনেক ক্ষেত্রেই প্রধানত বেতার ব্যবস্থাই প্রচলিত ছিল এবং এখনো আছে এবং বুলেটিন বা ছোটকাগজ প্রকাশের মাধ্যমে তারা জনগণ ও মুক্তিফৌজের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখতেন এবং এখনো রাখছেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র”। এই বেতারকেন্দ্র থেকে অন্য সব কর্মসূচির মধ্যে সংবাদ প্রচার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।এই সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে বিবিসি,ভয়েস অব আমেরিকা (VOA),আকাশবাণী ও হাতে পাওয়া সংবাদপত্রের উপর নির্ভর করত। যুদ্ধ যখন বিভিন্ন ফ্রন্টে নিয়মিত হতে শুরু হল এবং খবরের সোর্স বাড়তে থাকলো তখন “স্বাধীন বাংলা বেতার” থেকে বুলেটিনের সংখ্যাও বেড়ে গেল এবং একই খবর যাতে বারবার প্রচার না হয় সেদিকেও চিন্তাবান হতে হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক দিন কলকাতায় অবস্থিত ফোর্ট উইলিয়ামই ছিল খবরের প্রধান সোর্স । এর মধ্যে কেউ কলকাতায় এলে তাদের কাছ থেকে ও খবর সংগ্রহ করা হতো। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন এলাকার নেতৃবৃন্দ তাদের কাজের খবর পাঠাতো।কেউ কেউ রণাঙ্গন থেকেও অনেক সংবাদ পাঠাতেন ।
রণাঙ্গনের সাংবাদিকতা প্রথাগতভাবে কেউ করেননি, তবে রণাঙ্গন সংবাদদাতা ছিলেন বেশ ক’জন, যাঁরা নিয়মিত না হলে ও মাঝে মাঝে টেলিগ্রাম করতেন অথবা লিখিতভাবে রিপোর্ট পাঠাতেন।এছাড়াও ওয়্যার নিউজ যা কিছু ফোর্ট উইলিয়ামে স্থাপিত সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তরে আসতো তার মধ্য থেকে কিছু “আকাশবাণী” ও কিছু “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে” পাঠিয়ে দেয়া হতো।
কিন্তু “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” ছিল সবচেয়ে কার্যকর । প্রবাসী শরণার্থী, রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা কিংবা অবরুদ্ধ বাংলায় বাঙালি মাত্রই জয় বাংলার সৈনিক ছিলেন। ওরা সবাই “স্বাধীন বাংলা বেতার”,” জয় বাংলা” রেডিও শুনতেন । বাংকারে কিংবা ক্যাম্পে শত্রুর প্রতীক্ষায় কিংবা আর পাকিস্তানি হানাদার আক্রান্ত বাংলার ঘরে ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে অথবা লেপের তলায় কানের কাছে নিয়ে শুনতেন এই “স্বাধীন বাংলা বেতার”।এর আরও একটি বড় কারণ তখন গণমাধ্যম হিসেবে রেডিও সবচেয়ে সহজলভ্য ছিল।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সর্বশেষ পর্যায়ে সবাই মিলিত হয়েছিল । চট্টগ্রাম,ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর বিভিন্ন কেন্দ্রের বাঙালি কর্মচারী, কিছু সাংবাদিক এবং লেখক ও শিক্ষাবিদ জমায়েত হয় কলকাতায়। লক্ষ্য ছিল, দেশমাতৃকাকে পাকিস্তানি হানাদার দুশমনদের হাত থেকে রক্ষা করা এবং যারা সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করছেন কিংবা যারা অবরুদ্ধ বাংলায় নানা নির্যাতনে দিনাতিপাত করছেন তাদের মনোবল জোরদার করা এবং সাহসের যোগান দেয়া। সাধারণ কিংবা অশিক্ষিত মানুষের নির্ভরতা সেদিন ছিল দেশের “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” কিংবা “জয়বাংলা রেডিও” এর ওপর আর বিদেশি বলতে বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকায়।
একাত্তরের লড়াই শুধু psychological warfare কিংবা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধই ছিল না, ছিল সম্মুখ সমর।অসম যুদ্ধ। অসংখ্য নিরস্ত্র মানুষের সঙ্গে প্রশিক্ষিত যুদ্ধবাজ সৈন্যবাহিনীর লড়াই।তাই বেতারের যুদ্ধ ও ছিল অন্যতম প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ। একে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট বলে গণ্য করতে চায়।
জন্মকালে “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র” হিসেবেই উচ্চারিত হয়েছিল নামটি। ক’জন রাজনীতি সচেতন বাঙালি তরুণ বেতার কর্মী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । পর্যায়ক্রমে যাঁরা এই বেতার পরিচালনায় সঙ্ঘবদ্ধ হন, তাঁরা হলেন- বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ,মোস্তফা আনোয়ার, আমিনুর রহমান,রাশেদুর রহমান, আব্দুল্লাহ আল-ফারুক,শরফুজ্জামান, সৈয়দ আবদুস শাকের, রেজাউল করিম চৌধুরী এবং কাজী হাবিব উদ্দিন। এই দশজনের চক্র সেদিন পাকিস্তানি হানাদারদের তাজ্জব করে দিয়েছিল। চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন কেন্দ্রে ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় এর সূচনা।ডা. সৈয়দ আনোয়ার আলী,কাজী হোসনে আরা, মঞ্জুলা আনোয়ার এরাও এই উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একক প্রোগ্রাম হিসেবে চরমপত্র ছিল সবচেয়ে বেশি আকর্ষনীয় ও মোটিভেশনাল। এতে আঞ্চলিক ভাষা ও কৃত্রিম কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে ব্যঙ্গাত্মক রচনা তৈরি ও পরিবেশন করতেন এম আর আখতার মুকুল। এই প্রোগ্রামের জনপ্রিয়তা সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। আজও তার গ্রহণযোগ্যতা অনন্য। এরপরই উল্লেখ করতে হয় “জল্লাদের দরবার” নাটক।
কল্যাণমিত্র লিখতেন আর রাজু আহমদ, সুভাষ দত্ত,নারায়ন ঘোষ, সুমিতা দেবী প্রমুখ অভিনয় করতেন। এছাড়া বহু মুক্তিযুদ্ধের নাটক, কবিতা আবৃত্তি, সাক্ষাৎকার,কথিকা প্রচারিত হয়েছে।
বহু শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আমলা, শিক্ষাবিদ সবাই এক হয়ে যে ক্ষুরধার প্রচার উপকরণ তৈরি করতেন, তা-ই “স্বাধীন বাংলা বেতার” পৌঁছে দিত বাংলা’র ঘরে-ঘরে। “বজ্রকন্ঠ” ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতার অংশ, উদ্ধৃতিমূলক শ্লোগান অনুষ্ঠান। প্রতিদিন প্রতি অধিবেশনেই এটি প্রচার করা হতো মানুষের মনোবল আরো জোরদার করার জন্য। “ইসলামের দৃষ্টিতে”, “রাজনৈতিক মঞ্চ”, “পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে”, “দৃষ্টিপাত”, “রণাঙ্গনের চিঠি”, “পিন্ডির প্রলাপ”, “কাঠগড়ার আসামী” প্রভৃতি অনুষ্ঠান প্রচার হতো।
মুক্তিকামী বাঙালি জনগণের মনের আকাঙ্ক্ষাকে পূরণের প্রবল প্রত্যয়ে, এই লেখা ও প্রচার অবরুদ্ধ বাঙালি শরণার্থী বাংলার মানুষ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় সঙ্গত বিদ্রোহের লড়াকু সৈনিকদের উদ্দীপ্ত করেছে। মুক্তিযুদ্ধে জানকে বাজি রাখার সাহস জুগিয়েছে। বস্তুতই মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কবলিত এলাকার যোগসূত্র হিসেবে “স্বাধীন বাংলা বেতার” জনগণের মনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । এক অনন্য সাধারণ বলিষ্ঠ নিদের্শক ভূমিকা পালন করেছে “স্বাধীন বাংলা বেতার”।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণমাধ্যম-কামাল লোহানী।
লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী
জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্ট্যাডিজ বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়