সারাদেশ

যেভাবে পদ্মা সেতু হয়ে ইউরোপ যাবে ট্রেন

পদ্মা সেতু নিয়ে সাদা চোখের বিশ্লেষণে একটি কথা ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে- সেতু হওয়ায় দেশের ২১ জেলার সঙ্গে বিশেষত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী শহরের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে পদ্মা সেতু অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি বড় মাইলফলক।

শনিবার (২৫ জুন) সেতু উদ্বোধনের পরদিনই দেখা যায় রোববার (২৬ জুন) ভোর ৬টা থেকে সেতুর জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে সারি সারি যানবাহন। এর মধ্যে ট্রাকগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বাজারের পণ্য, সিলিন্ডার, কারখানার সরঞ্জাম।

স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে- দক্ষিণাঞ্চল অনেক দূর, এ কথাটিকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে পদ্মা সেতু।
সেতুর টোল প্লাজার সামনে সময় সংবাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ইউসুফ আলীর। তিনি জানান, আগের দিনও তারা মাঠের সবজি স্থানীয় বাজারে নিয়ে বিক্রি করেছেন। আজকে পিকআপে করে সবজি নিয়ে রওনা হয়েছেন ঢাকার কারওয়ান বাজারে। প্রতিটা মানুষের চোখে-মুখে ছিল খুশির ঝিলিক। তবে এই আনন্দ কেবল দেশে নয়, ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুর আদ্যোপান্ত

বিশেষ করে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে উঠে এসেছে পদ্মা সেতু নিয়ে কলকাতার মানুষের উন্মাদনার কথা। একের পর এক সরকার প্রধান ও বিদেশি মিডিয়া প্রশংসা করছে বাংলাদেশ সরকারের। কিন্তু একটি সেতু নিয়ে এতটা উন্মাদনা কেন সবার? এটি কেবলই খরস্রোতা নদীর বুকে বিশাল সেতু বানানোর কৃতিত্ব নাকি অন্যকিছু।

বিহঙ্গচোখে তাকালে দেখা যায়, পদ্মার যোগাযোগ ব্যবস্থা কেবল দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে সারাবিশ্বে। বিশেষ করে এশিয়ান হাইওয়ের যে স্বপ্ন দেখছে এশিয়াভুক্ত দেশগুলো, তাদের স্বপ্নের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এখন পদ্মা সেতু, সে কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়।

১৩ বছর আগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সঙ্গে এশিয়ান হাইওয়ে সম্পর্কিত একটি গ্রুপে যুক্ত হয়। এই মহাসড়কের মাধ্যমে এশিয়ার ৩২টি দেশের সঙ্গে আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থা সুগম হবে, তৈরি হবে ১ লাখ ৪৫ হাজার কিলোমিটারের বিশাল সড়ক পথ। এই সড়ক পথের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রুট যাবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। এশিয়ান হাইওয়ে-১, এশিয়ান হাইওয়ে-২ ও এশিয়ান হাইওয়ে-৪১ রুটের ১ হাজার ৭৭১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বিশাল সড়কপথটির অবস্থান হবে বাংলাদেশের মানচিত্রে।

এশিয়ান হাইওয়ে-১ এর রুট হচ্ছে ভারতের আসাম হয়ে সিলেট, ঢাকা, নড়াইল, যশোর ও সবশেষে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। এই পথের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল পদ্মা নদী। সেতু হয়ে যাওয়ায় এক মহাসড়কে দ্রুততম সময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে যাতায়াত করা যাবে। ধারণা করা যাচ্ছে, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এই হাইওয়ের রুটে বাংলাদেশ থেকে সড়কপথে সিঙ্গাপুর ও ইউরোপে যাওয়া যাবে।

কেবল সড়কপথ না, এশিয়ার রেলপথের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের স্বপ্নও পূরণ হচ্ছে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হলে এশিয়ার ২৮টি দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগব্যবস্থা চালু হবে। অর্থাৎ একটি সামগ্রিক বিশ্বায়নে বিপ্লব এনে দিয়েছে পদ্মা সেতু। সিঙ্গাপুর থেকে ইউরোপে ট্রেন যাবে পদ্মা সেতু হয়েই। দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গেও যুক্ত করবে এই সেতু। আর এ নেটওয়ার্ক চালু হলে ভারত, ভুটান ও নেপালে সরাসরি যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের দুয়ার খুলবে।

আরও পড়ুন: দেশের প্রথম দোতলা সেতু পদ্মা সেতু

সেতুর দুই পাড়ে চার লেনের এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা থাকায় এটি মোংলা ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে যুক্ত করবে। যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে। ঢাকা, বেনাপোল ও তামাবিল হয়ে ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান যাওয়া যাবে এ সড়ক ধরে।

বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর ওপর ১৭ কিলোমিটার রেল ব্রিজ নির্মাণ হলেই ট্রান্স এশিয়ান রেলে যুক্ত হবে এই সেতু। এর মাধ্যমে যোগাযোগ ঘটবে এশিয়া ও ইউরোপে। ইতোমধ্যে গেন্ডারিয়া, মাওয়া, জাজিরা, ভাঙ্গা রুটের কাজ প্রায় শেষ। এই পথ ধরেই দেশ হয়ে দেশের বাইরে যাবে রেলগাড়ি।

মূলত ঢাকা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নড়াইল, ফরিদপুর, যশোর, বেনাপোল-উত্তরে চিলাহাটি হয়ে দার্জিলিং পর্যন্ত যাবে এই পথ। যা ইস্তাম্বুল, তেহরান, ইসলামাবাদের সঙ্গে ঢাকা-দিল্লিকে যুক্ত করবে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত হবে দুই মহাদেশের দুই দূরতম প্রান্ত। যা ঢাকাকে ছুঁয়ে যাবে। আর ইস্তাম্বুলকে যুক্ত করবে টোকিওর সঙ্গে।

ট্রান্স এশিয়ান নেটওয়ার্কে যখন সিঙ্গাপুর থেকে ইউরোপে ট্রেন যাবে, তখন পদ্মা সেতু হয়ে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে যাবে এই পথ ধরে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতেও এত দ্রুত গতিতে কোনো সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলে না। পণ্য-যাত্রী নিয়ে ছুটবে এই ট্রেন, তাই সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে হেভি লোডেড সেতু ও রেলপথ বানানো হয়েছে।

এশিয়ান হাইওয়ে-১ ও এশিয়ান হাইওয়ে-২ কে বাস্তবায়ন করতে গেলে পদ্মা সেতুর কোনো বিকল্প ছিল না। এই হাইওয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশতো বটেই, সারা এশিয়া চলে আসবে নিরবচ্ছিন্ন এক যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায়। তাইতো প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে গণ্যমান্য সবার কাছে পদ্মা সেতু এক বিরাট অর্জন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker