বিনোদনভাইরাল

তারা কেন ভাইরাল? (ভিডিও)

বিনোদন ডেস্ক : নিজেকে উপস্থাপনের অন্যতম প্লাটফর্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে চোখের পলকেই যুক্ত হওয়া যায়। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে গান। অনেক গানের কথা বোঝা যায় না। কিন্তু গায়কি, গানের সঙ্গে নাচ বা ভিডিও উপস্থাপনার কারণে গানগুলো দর্শক ও শ্রোতাপ্রিয়তা পাচ্ছে।

মুহূর্তেই টিকটক, লাইকিতে গানগুলো ভাইরাল হচ্ছে। ভাইরাল হওয়ার নেশায় মেতে উঠেছে অনেকে। রাতারাতি তারকাখ্যাতিও পাচ্ছেন। এই ধরনের ভাইরাল হওয়া গান সমাজে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কখনও তা ইতিবাচক আবার কখনও নেতিবাচক।

ভুবন বাদ্যকর : সম্প্রতি ওপার বাংলার ভুবন বাদ্যকরের ‘কাঁচাবাদাম’ গানটি নেট দুনিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। বলতে গেলে দেশজুড়ে বইছে কাঁচাবাদামের ঝড়! সবার মুখে মুখে এখন কাঁচাবাদাম। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের সামাজিকমাধ্যমে সয়লাব এই গান।

অনেকের মতে, উপমহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই গান এখন বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষাভাষি মানুষের মুখে মুখে। তবে অনেকেই জানতেন না, এই গানের গীতিকার, সুরকার আর গায়ক কে বা কারা? আর গানটি এলো কোথা থেকে! কেনইবা ভাইরাল হলো? সেই অর্থে ‘কাঁচাবাদাম’ কোনো গান নয়। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে এক বাদামওয়ালার মুখে মুখে বানানো কথামালা।

ভাইরাল হওয়া ‘কাঁচাবাদাম’ গানের স্রষ্টার নাম ভুবন বাদ্যকর। তিনি একজন বাদাম বিক্রেতা। তার বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের দুবরাজপুর ব্লকের অন্তর্গত লক্ষ্মীনারায়ণপুর পঞ্চায়েতের কুড়ালজুরি গ্রামে। সেখানে একটি মোটরসাইকেলের পেছনে বাদাম নিয়ে গ্রামে, বাজারে, বন্দরে, মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাদাম বেচেন। ভাজা বাদাম বিক্রি করেন না ভুবন।

তার কাছে পাওয়া সব বাদামই কাঁচা। আর শুধু টাকা দিলেই বাদাম মেলে না। বাড়ির অব্যবহৃত পুরনো যন্ত্রাংশ, নষ্ট মোবাইলের যন্ত্রাংশ, ব্যাটারি, হাঁসের পালক, মাথার চুল, সিটি গোল্ডের চেইন, দুল, চুড়ির মতো গহনার বিনিময়ে বাদাম দিয়ে থাকেন ভুবন।

আর এসব তথ্য গানে গানে বলে বেড়ান ভুবন, যা আজ ‘কাঁচাবাদাম’ গান হয়ে বিশ্বজুড়ে ভাইরাল। গানের কথাগুলো এমন- ‘বাদাম বাদাম দাদা কাঁচা বাদাম, আমার কাছে নাই গো বুবু ভাজা বাদাম…।’

গানটির কথা, সুর ভুবন বাদ্যকরেরই। এর গায়কও তিনি। ভুবনের এই গানের কথায় ও সুরে মজেননি এমন মানুষ এখন হাতে গোনা। ফেসবুক, ইউটিউব, রিলস খুললেই বেজে উঠছে এই গান।

রীতিমতো সেলিব্রিটি বনে গেছেন বাদাম বিক্রেতা ভুবন বাদ্যকর। তাকে দেখতে ভিড় জমছে তার বাড়িতে। তিনি যখন যে গ্রামে বাদাম বিক্রি করতে যাচ্ছেন, সেখানেই তাকে দেখতে ভিড় করে আসছেন সাধারণ মানুষ। ভারতীয় গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন ইতোমধ্যে।

এভাবে ভাইরাল হয়ে ভুবনও বেশ উচ্ছ্বসিত। নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে বললেন, ‘মোবাইলে আমার গান দেখছে সবাই। দেখা হলেই সবাই এসে আমার গানের প্রশংসা করে যাচ্ছে। ভালোই লাগছে। গানটি আমিই লিখেছি, আমারই তৈরি। আমারই সুর, আমারই গলা। চিন্তাভাবনা করতে করতেই করেছি। বিগত ১০ বছর ধরে বাদাম বিক্রি করছি। আমি বাদাম বিক্রি করতে গিয়ে এই গান করি। সেই সময় কোনো একটি ছেলে সেই গান ক্যামেরা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু আমি সেই ছেলেটিকে চিনি না।’‌

আগে কখনও গান করতেন প্রশ্নে ভুবন বলেন, ‘হ্যাঁ, এর আগে বাউল গান করেছি। এখন আমি ঝাড়খণ্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাদাম ফেরি করি। সেই বাদাম কী করে বিক্রি করা যায়, সেই থেকেই ভাবনাচিন্তা। তারপরই গান লেখা।’

ভাইরাল হওয়ার পর বিক্রি বেড়েছে বলে জানান ভুবন, ‘গান শুনে বহু মানুষই বাদাম কিনতে আসছেন। কেউ পাঁচ টাকার বাদাম কিনছেন, কেউ ১০ টাকার। বিক্রিবাটা ভালোই চলছে। আগে পায়ে হেঁটে বাদাম ফেরি করতাম। কিছুদিন সাইকেলেও করেছি। এখন ১৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি মোটরসাইকেল কিনেছেন। তাতে করেই বাদাম ফেরি করছি।’

অপু ভাই : রং করা চুল আর বিভিন্ন সংলাপ বলে নেটিজেনদের হাসির খোরাক জুগিয়েছেন অপু। টিকটকে তিনি ‘অপু ভাই’ নামেই পরিচিত। এরপরপরই তিনি বাংলাদেশের দুই জনপ্রিয় পরিচালকের ওয়েব ফ্লিম ও ওয়েব সিরিজে অভিনয় করেন। এরপর থেকেই ফেসবুকে তুমুল সমালোচনা চলছে তাকে নিয়ে। টিকটকার পরিচয়ের পাশাপাশি তার ‘অভিনয় জ্ঞান’ নিয়েও বিদ্রূপ করছেন অনেকেই।

অপুকে গ্রামের মানুষ চেনে ইয়াসিন নামে। টিকটক ভিডিও বানানোকে ঘিরে একটি মারামারির ঘটনায় ঢাকার উত্তরায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে এলাকাবাসী তাদের ইয়াসিনকে নতুনভাবে ‘অপু’ নামে জানে।

ইয়াসিন আরাফাত অপুর বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নে। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর সোনাইমুড়ি পৌরসভার কৌশল্যারবাগ গ্রামে নানার বাড়িতে বড় হয় সে। সেখানে কৌশল্যারবাগ তালিমুল কোরআন নূরানী কাওমি মাদরাসায় দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। অভাব-অনটনের কারণে বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেনি অপু।

মোবাইল ও টিভি মেকানিকের কাজ শিখে কিছুদিন সার্ভিসিংয়ের কাজ করেন। এরপর সোনাইমুড়ি বাজার ও জেলা শহরের বিভিন্ন সেলুনে কাজ শুরু করেন অপু। সেলুনে খুব ভালো কাজ করতো সে। কিন্তু সেলুনে কাজ করার সময় টিকটক, লাইকিতে আসক্ত হওয়ার পর সে কাজে উদাসীন হয়ে পড়ে। টিকটক, লাইকি কর্তৃপক্ষ আরও সুন্দরভাবে ভিডিও বানানোর জন্য তাকে ফ্ল্যাশ লাইটসহ বিভিন্ন কিছু গিফট করে।

অপু এলাকায় দল বেঁধে ঘুরে এবং মোবাইলে ভিডিও বানানো শুরু করে। আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকেও কিশোর-তরুণরা তার সঙ্গে ভিডিও বানাতে আসে। অপুর সঙ্গে ভিডিও বানাতে ঢাকা থেকে গাড়ি রিজার্ভ করেও অনেক তরুণ তার গ্রামে যেত।

গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকায় এসেও নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখেন অপু ভাই। চুলের কালার এবং বিভিন্ন সংলাপ তাকে আলোচনার তুঙ্গে রাখে। কিন্তু একের পর এক মারামারির ঘটনায় বিতর্কিত হয়ে পড়েন তিনি। শেষ পর্যন্ত হাজতবাসও করতে হয়। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই আমূল পরিবর্তন ঘটে তার। নিজেকে শুধরে নিতে শুরু করেন তিনি। ফিরে এসে ইউটিউবে নিয়মিত হন।

হিরো আলম : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘হিরো আলম’ মানে ভাইরাল কনটেন্ট। ইউটিউব থেকে ফেসবুক, লাইকি সবখানেই তার জনপ্রিয়তা! তার যেকোনো নাটক, সিনেমা এবং গান মুহূর্তেই নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ওপার বাংলায় পরিচিত মুখ তিনি। কী কারণে হিরো আলম এত জনপ্রিয়? তার সদুত্তর শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনরা দিতে পারছেন না। সম্প্রতি হিরো আলমের গাওয়া ‘বাবু খাইছো’, ‘মানিকে মাগে হিতে’ গানগুলো ভাইরাল হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, কাঁচা বাদাম গানটিও হিন্দিতে গাইবেন তিনি। মূলত তিনিও যা মনে চায় তাই গান।

রানু মন্ডল : এই নামটি এখন সবারই কাছে ভীষণ পরিচিত। স্টেশনে গান গেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক ভাবে ভাইরাল হয়েছিলেন তিনি। কোনোরকম তালিম ছাড়া তিনি যেভাবে গান গেয়েছিলেন, তাতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন দর্শকগণ। রাতারাতি লতাকণ্ঠী হিসেবেও পরিচিতি পান তিনি। এরপরে স্টেশনে বসে ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করা রানু মণ্ডল এর জীবন এক নিমেষে বদলে গিয়েছিল। ভাইরাল হওয়ার পর তাকে লাইমলাইটে আনা হয়। সুযোগ পান বলিউডের সংগীতজগতে। হিমেশ রেশমিয়ার সহায়তায় প্রথম প্লেব্যাক গানের সুযোগ পান। তেরি মেরি কাহানি গান গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে নেন।

এই পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকভাবেই চলছিল। কিন্তু তারপরেই ছন্দপতন। নিজের দুর্ব্যবহারের জন্য অনুরাগীদের কাছেও অপছন্দের হতে থাকেন তিনি। এ ছাড়াও কাজের অভাব, লকডাউন নানা কারণে জনপ্রিয়তা হারান। নিজের বাড়িতে আবার ফিরে আসেন তিনি। বর্তমানে গানের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ না থাকলেও অনেকের গান গেয়ে তিনি নিজেকে ধরেখেছেন।

তবে প্রায়ই দেখা যায় ভাইরাল বিষয়গুলোতে একশ্রেণির মানুষ যুক্ত হয় কারণ তারা মনে করেন সময়ের সঙ্গে পিছিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, মজা করার জন্য পোস্ট করেন। অনেকেই বিষয়টিকে মানসিক সমস্যাও বলছেন।

এ প্রসঙ্গে, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ হেলাল গণমাধ্যমে বলেন, ‘মানুষ যখন কোনো একটা ঘটনার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারেন প্রথমত তখন তা ভাইরাল হয়। তেমনি মানুষের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে কাঁচাবাদাম গানের কথা মিলে যাওয়ায় তা ভাইরাল হয়েছে। আরেক শ্রেণির মানুষ আছেন, যারা মনে করেন স্রোতের তালে গা না ভাসালে আমি হয়তো পিছিয়ে যাব। তারাও তখন ভাইরালের পিছু নিয়ে মজা করা কিংবা পোস্ট করায় অংশ নেয়। ভাইরাল বিষয় যখন নেতিবাচক প্রচার হয়, তখনও একশ্রেণির মানুষ এতে যুক্ত হয় কারণ তারা মনে করেন আমি পিছিয়ে যাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের জানা উচিত কোথায় থামতে হবে। বাস্তব জীবনে আমরা যেমন বড়দের সম্মান করি, ছোটদের স্নেহ করি, নিয়ম মেনে পোশাক পরি, সংস্কৃতি মেনে চলি; তেমনি সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু আদব-কায়দা আছে তা মেনে চলতে হবে। তাহলে এই ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাব।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker